রবিবার, ২৯ Jun ২০২৫, ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন
মোস্তফা কামাল:
সানুল হক ইনু, আবদুস সোবহান গোলাপ, অসীম কুমার উকিল, শিল্পী মমতাজ বা তৈমূর আলম খন্দকারদের রাজসাক্ষে বাংলাদেশের বাস্তবতায় কিচ্ছু যায়-আসে না। নির্বাচনে জিতে বড়সড় মন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছেন এমন কেউ কারচুপি জালিয়াতির সাক্ষ্য দিলেও কিছু যাবে, আসবে না। কিছু হবে না। কাস্টিং ভোটের হারেও ম্যাটার করে না। আমাদের নির্বাচনী আইন-বিধান এ রকমই। মোট কথা, নির্বাচন হয়ে গেছে এবং এ নির্বাচন বৈধ। সরকারও বৈধ। কেবল বৈধই নয়, গ্রহণযোগ্যও।
চলমান বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের সময় সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর পাল্টাপাল্টি অবস্থানে নির্বাচন হয়েছে বাংলাদেশে। যুদ্ধ চলছে বিশ্বের অন্তত ২৭টি দেশে। আর এ বছর নির্বাচন হচ্ছে বাংলাদেশসহ ৩০টি দেশে। ভৌগোলিক পরিমাপে তা বিশ্বের অর্ধেক। বিশ্বের টপ সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬০তম চতুর্বার্ষিক রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এ বছরের শেষদিকে ৫ নভেম্বর। রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী আলেক্সি নাভালনিকে ১৯ বছর ধরে সাজা ভোগ করাচ্ছেন। আসন্ন নির্বাচনে পুতিন স্বতন্ত্র নির্বাচনে জেতার মধ্য দিয়ে আর কোনো দলের না হয়ে সবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। প্রতিবেশী ভারতেও নির্বাচন আসন্ন। এপ্রিল-মে মাসে দেশটির প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ তাদের নেতা নির্বাচনে ভোট দেবেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার দল বিজেপি তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় যাওয়ার আশা করছে। মধ্য জুনে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৪০ কোটির বেশি মানুষ ভোট দেবেন। জুনে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও। ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায়ও এ বছরই নির্বাচন। বছর জুড়ে এসব নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর সেগুলোর সঙ্গে তুলনা ও আলোচনা হবে কেমন হয়েছে বাংলাদেশের নির্বাচন।
এরই মধ্যে তাইওয়ানে নির্বাচন হয়ে গেছে। এ নিয়ে আরেক উত্তেজনা। তাইওয়ানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তেকে অভিনন্দন জানিয়ে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োকো কামিকাওয়ার দেওয়া বিবৃতির ‘পুরোপুরি বিরোধিতা’ করেছে জাপানস্থ চীনা দূতাবাস। গত রবিবার ১৪ জানুয়ারি এক বিবৃতির মাধ্যমে চীনা দূতাবাস এই নিন্দা জ্ঞাপন করে। স্নায়ুযুদ্ধের এমন সময়ে কে কখন কার নির্বাচনকে অভিনন্দন বা নিন্দা জানাবে তার ঠিক-ঠিকানা থাকে না। সময়টা বড় জটিল এবং কঠিন। সংঘাত অনিবার্য জেনেও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো এখন সমরাস্ত্র বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় রয়েছে। রুশ-ইউক্রেন, ফিলিস্তিনে ইসরায়েল-হামাসের মতো গোলাবারুদে মুখোমুখি না হলেও স্নায়ুযুদ্ধ চলছে দেশে-দেশে, মহাদেশে-মহাদেশে। তা এশিয়া জুড়েও। ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় বিশ্বকে দুমড়ে-মুচড়ে দিচ্ছে। এর ছিটেফোঁটা এশিয়ায় উদারনীতি ও স্বৈরতন্ত্র নিয়েও। এখানেও হাতছানি পশ্চিমাদের। সরাসরি লড়াই যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের মধ্যে। এর শেকড় কয়েক দশক পেছনে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধের ধরন ভিন্ন। পরিস্থিতির ভয়াবহতাও বেশি। যুদ্ধ এখন শুধু সমরাস্ত্রের নয়, তা চলে অর্থনীতি ও প্রযুক্তিতেও। কিছু লড়াই চোখেও দেখা যায় না। কিন্তু জনজীবনে এর প্রভাব মারাত্মক। বিশ্বে প্রতিদিন এমন অনেক প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, যাদের জন্ম যুদ্ধের ময়দানে। বেড়ে ওঠাও তাই। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জন্মগ্রহণকারীদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে জন্মানোদের মনস্তাত্ত্বিক যে তফাত গড়ে উঠছে তা আগামী বিশ্বকে অশান্তিময় করে তুলবে। যার নমুনা কোরীয় উপদ্বীপ, পূর্ব চীন সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর, মিয়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান বনাম যুক্তরাষ্ট্র, ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, নাইজেরিয়া, মালি, লিবিয়া, মিসর, ইসরায়েল, আফগানিস্তান, লেবানন, ইরাক, তুরস্ক, ইউক্রেন, কাজাখস্তান, ভেনেজুয়েলা, মেক্সিকোসহ আরও নানা দেশ ও অঞ্চলে। যুক্তরাষ্ট্র প্রাসঙ্গিক সবখানেই। পিছে পিছে রাশিয়াও।
একদিকে দেশে দেশে ভোট, আরেকদিকে যুদ্ধ এই রসায়ন বিশ্বকে কোথায় নেবে উদ্বেগ আছে অনেকের। বিশ্বে এখন সচরাচর কারও ভূমি বা মানচিত্র কেউ নিয়ে যায় না। অর্থনীতি কবজায় নেয়। দেশে দেশে মোড়লিপনার হাব বানায়। কোনো দেশ পারলে ঠেকায়, না হলে বগলে নেয়। সদ্য উদাহরণ ছোট দেশ মালদ্বীপ। দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু চীন সফর করে ফিরেই ১৫ মার্চের মধ্যে সব ভারতীয় সেনা সরাতে নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের পূর্ব-পশ্চিমের হাব হওয়ার টার্গেট। বৈশ্বিক মেরুকরণের একটি বিশেষ ভ্যানু বা পার্ট হয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বশক্তির বড়দের লড়াইয়ে বাংলাদেশ তা কীভাবে সামলাবে এ প্রশ্নের কিছুটা জবাব প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। নির্বাচনে জয় উপলক্ষে অভিনন্দন জানাতে ৯ জানুয়ারি গণভবনে এসেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তাদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছেন বিদেশি প্রভুদের পরামর্শ মেনে চললে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে কেউ টিকে থাকতে পারবে না। বাস্তবে বন্ধুরূপী প্রভূতে ঘুরছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাহীন সব পক্ষই বিদেশি শক্তির নাগালে ধন্য হচ্ছে। ভারত-রাশিয়া-চীনসহ কিছু দেশ নির্বাচন ভালো হয়েছে বলায় ক্ষমতাসীনরা খুশি। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ বিপরীতটা বলায় খুশি বিএনপি, জামায়াতসহ কিছু দল। বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর মন-মর্জির এই দুই স্পষ্টতা বন্ধুত্বের না প্রভূত্বের, তা ব্যাখ্যার দরকার হয় না। স্পষ্ট বা ভ্যানুটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোই ঠিক করে দিয়েছে। নির্বাচনের আগে তা আরও পাকাপোক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দমনপীড়ন নিয়ে ছিল সোচ্চার।
আরেকদিকে ভারত, চীন, রাশিয়া। নির্বাচনের পর তা একদম প্রকাশ্যে। ভারত, চীন, রাশিয়াসহ কয়েক দেশ নির্বাচনের বেসরকারি ফলাফলের পরপরই শেখ হাসিনার টানা চতুর্থবারের বিজয়ে উল্লাসের প্রকাশ ঘটায়। এসব দেশের ঢাকাস্থ কূটনীতিকরা কেবল সমর্থন-বিবৃতি নয়, গণভবনে সশরীরে ছুটে যেতেও দেরি করেননি। বেসরকারি ফল প্রকাশের পরই রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুরসহ বেশ কিছু দেশের রাষ্ট্রদূত শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, ব্রুনেই দারুসসালাম, মালয়েশিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতরাও বাদ যাননি। ভোটগ্রহণের আগে থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হচ্ছে বলে মন্তব্য পাওয়া গেছে রাশিয়ার পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে। দেশটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার আন্দ্রে ওয়াই শুটব বলেছেন, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য উপায়ে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আয়োজনও চমৎকার ছিল। এই ঘোর সমর্থনের বিপরীতে অবস্থান জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের। তারা মনে করে, বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মর্মাহত হয়েছে এ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ না নেওয়ায়। নির্বাচনকালীন সহিংসতায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। সমমনাসহ প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোটের রেসেই থাকেনি। আবার সরকারি ঘরানার নক্ষত্ররা ঝরে গেছে ভোটের হর্স রেস থেকে। ডামিদের দামি বেটিংয়ে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হাসানুল ইক ইনু, ফজলে হোসেন বাদশার মতো তারকা নেতারা ঝরে গেছেন হর্স রেস থেকে। নির্বাচনে জালিয়াতি-কারচুপির বিলাপ করা ছাড়া তাদের আর করণীয় কিছু নেই। সরকারি প্রণোদনায় টিকে থাকা জাতীয় পার্টির ৯০ শতাংশ প্রার্থীর জামানত হারিয়ে গেছে। আসন ভাগযোগ, মনোনয়ন বাণিজ্য এবং সরকার থেকে পাওয়া টাকার বাটোয়ারা নিয়ে দলটিতে গণ্ডগোল চরমে। অভ্যন্তরীণভাবে এক আজাবে পড়েছে জাতীয় পার্টি। সরকারের সহায়তায় গড়ে ওঠা তৃণমূল বিএনপি, বিএনএ, বিএনএম ধরনের দলগুলোর হাঁকডাক শেষ। একজনেরও জামানত রক্ষা হয়নি। কান্নার জায়গাও পাচ্ছে না তারা। এমন অবস্থায় নির্বাচনে না গিয়েও এক ধরনের জয়ের ঢেঁকুর ছাড়ছে বিএনপি। দেখছে বাংলাদেশে কম্বোডিয়ার পরিস্থিতির সিনড্রম। সেখানে একতরফা নির্বাচনের পর শুরু হয়েছিল স্যাংশন-রেস্ট্রিকশনসহ মার্কিনি কড়া অ্যাকশন। বাংলাদেশেও যদি এখন যুক্তরাষ্ট্র সেই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়, সেই আশা বিএনপিসহ কারও কারও। কিন্তু সরকার তলে তলে সেই দায়মুক্তি-ঝুঁকিমুক্তি নিয়ে রেখেছে বলে জানান দিয়ে রেখেছে আগেভাগেই।
২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচনেরও সাক্ষী ছিলেন। তখনকার সিইসিরা অবসরের পর নিজেদের বাঁচিয়ে বিনা ভোট ও রাতের ভোটের কথা স্বীকার করেছেন। এতে কিছু হয়নি। তবে বিগত নির্বাচনের তুলনায় এবার রাজসাক্ষী বেশি এবং অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব তারা। তাই রাজসাক্ষীদের সাক্ষ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে কিনা, সেই প্রশ্ন ঘুরছে। বাহ্যত সরকার এতে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তাদের কাছে দুর্গন্ধ দুর্গন্ধই, এর ডিগ্রি পরিমাপ নিষ্প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
mostofa71@gmail.com